আমরা অনেক সময় উপনিষদের গভীর জ্ঞান এবং দর্শন নিয়ে আলোচনা করি, কিন্তু নারীর অধিকার এবং অবস্থান নিয়ে উপনিষদ কী বলে, তা নিয়ে খুব কম কথা বলা হয়। এই প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে নারীকে কেবল গৃহের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়নি; বরং তাদের জীবন এবং আত্মার মুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলি উপস্থাপন করা হয়েছে। আজ আমরা উপনিষদের আলোকে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করব।
নারীর মর্যাদা: শুরু থেকে সনাতন দর্শনে
উপনিষদের মূল দর্শন হল, সকল মানুষ আত্মা দ্বারা চালিত, এবং আত্মা লিঙ্গভেদ করে না। এখানে বলা হয়েছে:
“ইশা বাস্যমিদং সর্বং, যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।”
অর্থাৎ, সৃষ্টির প্রতিটি অংশ ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত। পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, কারণ তাদের সত্তা একই চেতনার অংশ।
নারীর অধিকার এবং শিক্ষা সম্পর্কে একটি অসাধারণ উদাহরণ হল গার্গী এবং মৈত্রেয়ী। গার্গী উপনিষদে এক প্রজ্ঞা ও তর্কশক্তির মূর্ত প্রতীক হিসেবে উল্লেখিত। তিনি রাজা জনক এবং ঋষি ইয়াজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক করেছেন। এই উদাহরণটি নারীর জ্ঞানচর্চার অধিকারকে শক্তিশালীভাবে তুলে ধরে।
নারী এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা
উপনিষদে নারীকে আধ্যাত্মিকতার পথে হাঁটার জন্য সবসময় উৎসাহিত করা হয়েছে।
“সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম।”
এই উক্তি আমাদের জানায় যে, জ্ঞান অর্জন এবং সত্যের সন্ধান করা প্রত্যেক মানুষের অধিকার, তা সে নারী হোক বা পুরুষ। মৈত্রেয়ী উপাখ্যান থেকে আমরা শিখি যে, নারীর কাছে শুধুমাত্র সংসার নয়, বরং মোক্ষ লাভের পথও গুরুত্বপূর্ণ।
যখন ঋষি ইয়াজ্ঞবল্ক্য তার স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে জিজ্ঞেস করেন তিনি ধন সম্পদ চান কি না, মৈত্রেয়ী সোজাসুজি বলেন:
“যেনাহং নামৃতা স্যাম কিমহং তেন কুর্যাম।”
অর্থাৎ, আমি যদি অমৃত হতে না পারি, তবে ঐ সম্পদের প্রয়োজন কী? এই বক্তব্য নারীর আত্মিক চেতনা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার গভীরতা বোঝায়।
নারী: শিক্ষার অধিকার এবং ক্ষমতায়ন
উপনিষদে নারীর শিক্ষার অধিকার বারবার গুরুত্ব পেয়েছে। তর্ক, জ্ঞানচর্চা, এবং আত্মজিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকার ছিল। উদাহরণস্বরূপ:
- গার্গী ব্রহ্মজ্ঞানের তর্কে ঋষিদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
- মৈত্রেয়ী জীবনের চরম লক্ষ্য সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান করেছেন।
“তত্ত্বমসি।”
এই বিখ্যাত উক্তি থেকে আমরা শিখি যে, তুমি সেই চেতনার অংশ, যে ঈশ্বর সর্বত্র বিদ্যমান। এটি নারীদের নিজস্ব পরিচয় এবং গুরুত্বকে স্বীকার করে।
সমসাময়িক জীবনে উপনিষদের শিক্ষা
আপনার জীবনেও নারীর অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য উপনিষদের শিক্ষাগুলি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনার শক্তি এবং জ্ঞান সীমাহীন, তবে আপনিও গার্গী বা মৈত্রেয়ীর মতো হয়ে উঠতে পারেন। এটি কেবল আত্মশক্তির কথা নয়, বরং সমাজে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও।
উপনিষদের আরেকটি বিখ্যাত উক্তি:
“আত্মানং বিদ্ধি।”
অর্থাৎ, নিজেকে জানো। এটি নারীদের প্রতি আহ্বান করে, তারা যেন তাদের প্রকৃত ক্ষমতা এবং সত্তাকে চিনতে শেখে।
উপসংহার
উপনিষদ আমাদের শেখায়, নারীর অধিকার হল জ্ঞানের অধিকার, আত্মার মুক্তির অধিকার, এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের অধিকার। গার্গী এবং মৈত্রেয়ীর মতো নারীরা প্রমাণ করেছেন যে, সত্য এবং জ্ঞান অর্জন করার জন্য নারী বা পুরুষ হওয়া কোনো বাধা নয়।
তুমি কি জানো, উপনিষদে বলা “তুমিই সেই” (তত্ত্বমসি) উক্তিটি তোমার মধ্যেও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক? এই চেতনা গ্রহণ করে তোমার জীবনে কেমন পরিবর্তন আনতে পারো? ভাবো, এবং তুমি নিজেই উত্তর খুঁজে পাবে।