উপনিষদে আত্মা ও পরমাত্মার ধারণা কী?

উপনিষদ—ভারতীয় দর্শনের গভীরতম শাখাগুলোর মধ্যে একটি। আপনি যদি জীবনকে গভীরভাবে বুঝতে চান, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে চান, উপনিষদ হতে পারে আপনার জন্য এক অনন্য পথপ্রদর্শক। এখানে আত্মা ও পরমাত্মার ধারণা মূল স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আত্মা কী? পরমাত্মা আবার কী? এ দুটি ধারণা আপনাকে আপনার জীবনের আসল অর্থ খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারে।

আত্মার ধারণা:

উপনিষদের মতে, আত্মা হলো আপনার প্রকৃত সত্তা। এটি দেহ নয়, মন নয়, বরং এর গভীরে এমন কিছু যা শাশ্বত, চিরন্তন। মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে, “দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।” এর অর্থ, একটি বৃক্ষে দুটি পাখির মতো, একদিকে আপনি ভোগ করছেন, অন্যদিকে আপনার আত্মা কেবল সাক্ষী। এই আত্মাই আমাদের সত্যিকারের পরিচয়।

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, এই দেহ একদিন নষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু আপনার অনুভূতি, জ্ঞান, চেতনাকে কী হবে? আত্মা তার উত্তর। এটি কোনো দিন জন্মায় না, কোনো দিন মরে না। যেমন কাটা যায় না তেমন পোড়ানোও যায় না। “ন জায়তে ম্রিয়তে वा কদাচিত্।”—কঠ উপনিষদের এই কথা প্রমাণ করে আত্মার অমরত্ব।

পরমাত্মার ধারণা:

পরমাত্মা হলো সর্বব্যাপী চেতনার উৎস। এটি এমন এক সর্বশক্তিমান সত্তা, যার সঙ্গে আত্মার সংযোগ রয়েছে। ব্রহ্ম উপনিষদে বলা হয়েছে, “একং সৎ, বিপ্রা বহুধা বদন্তি।” অর্থাৎ, সত্য এক, তবে মানুষ তাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে। পরমাত্মা হলো সেই সত্য, যে সবকিছুর উর্ধ্বে।

আপনার জীবনের যাত্রায় পরমাত্মা সেই দিশারির ভূমিকা পালন করে। আপনি যদি আত্মাকে নিজের মনে করুন, তবে পরমাত্মা হলো সেই মহাসমুদ্র, যার একটি অংশ আপনি। চণ্ডোগ্য উপনিষদ বলে, “তৎ ত্বম অসি”—তুমি সেই। এ কথায় বোঝানো হয়েছে, আত্মা ও পরমাত্মা আলাদা কিছু নয়। তারা একে অপরের পরিপূরক।

আত্মা ও পরমাত্মার সংযোগ:

আপনার ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—কীভাবে আত্মা ও পরমাত্মার সংযোগ স্থাপন করা যায়? উপনিষদ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। একান্ত ধ্যান, জ্ঞান ও ভক্তির মাধ্যমে আপনি এই সংযোগ উপলব্ধি করতে পারবেন।

যখন আপনি গভীর ধ্যানে বসেন, আপনি নিজের আত্মার সত্তা অনুভব করতে শুরু করেন। মনে করুন, আপনি একটি নদী। আপনার উৎস পাহাড়ে, কিন্তু আপনার শেষ লক্ষ্য সমুদ্র। নদীর মতোই আপনার আত্মাও একদিন তার উৎস পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবে। ব্রিহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, “যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রং গচ্ছন্তি।”

আপনার জীবনের ছোটখাটো সমস্যাগুলো যখন আপনাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে, তখন একবার ভেবে দেখুন, আপনি কেবল একটি শরীর নন। আপনার অস্তিত্ব তার থেকেও অনেক বড়। এই উপলব্ধি আপনার জীবনে শান্তি আনতে পারে।

দৈনন্দিন জীবনে উপনিষদের জ্ঞান:

উপনিষদ শুধু দর্শনের জন্য নয়; এটি আপনার দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার জন্য। আপনার জীবন যদি একটি যুদ্ধক্ষেত্র হয়, তবে আত্মা ও পরমাত্মার এই জ্ঞান হতে পারে আপনার অস্ত্র।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি রাগান্বিত হন, ভাবুন, সেই রাগ কি আপনার আসল সত্তা? আত্মা কী কখনো রাগ করে? এটি কেবল মন ও দেহের প্রতিক্রিয়া। কঠ উপনিষদ বলে, “অত্মানং রথিনং বিদ্ধি।”—আপনার শরীর হলো একটি রথ এবং আত্মা তার চালক। আপনি যদি এই জ্ঞান প্রয়োগ করেন, রাগ বা দুঃখ সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

আবার ধরুন, আপনার জীবনে হতাশা এসেছে। নিজেকে বলুন, এই দুঃখ ক্ষণস্থায়ী। আত্মা তো চিরন্তন এবং এর লক্ষ্য হলো পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়া। এই ভাবনা আপনাকে জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতার সামনে স্থির থাকতে সাহায্য করবে।

উপসংহার:

উপনিষদে আত্মা ও পরমাত্মার ধারণা কেবল দর্শন নয়, এটি আপনার জীবনবোধের ভিত্তি হতে পারে। যদি আপনি বুঝতে পারেন যে আত্মা অমর এবং এটি পরমাত্মার অংশ, তাহলে জীবনের ছোটখাটো ঝড়-ঝাপটা আপনাকে আর কাবু করতে পারবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top