উপনিষদের আলোকে বিশ্বশান্তির ধারণা কী?

উপনিষদের আলোকে বিশ্বশান্তির ধারণা কী?

উপনিষদ আমাদের সনাতন ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর প্রতিটি শ্লোক যেন গভীর জ্ঞানের একেকটি মণি। এই শাস্ত্রের মূল লক্ষ্যই হলো মানবজীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করা এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু শুধু ব্যক্তিগত শান্তি পেলেই কি সব শেষ? উপনিষদ আমাদের শেখায়, বিশ্বশান্তির ধারণাও একান্ত প্রাসঙ্গিক। এখানে আমি এবং আপনি একসঙ্গে উপনিষদের সেই শিক্ষাগুলোর সন্ধান করব, যেগুলো আমাদের বিশ্বশান্তির পথ দেখায়।

শান্তি মন্ত্র: সবার জন্য মঙ্গল কামনা

উপনিষদ শুরুই হয় শান্তি মন্ত্র দিয়ে। যেমন, “সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।” এই মন্ত্রের মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টির মঙ্গলের প্রার্থনা করা হয়। এই ধারণা শুধুমাত্র একটি প্রার্থনা নয়, বরং এটি আমাদের মনুষ্যত্বের মূল শিক্ষা। আপনি কি ভেবেছেন কখনো, এই মন্ত্রে যে ভাবনা রয়েছে, তা যদি সবাই নিজের জীবনে প্রয়োগ করে, তাহলে কি হবে? দুনিয়ার সবাই সুখী হবে, সবাই সুস্থ থাকবে—এটাই তো প্রকৃত বিশ্বশান্তি।

অদ্বৈত বেদান্ত: একাত্মতার ধারণা

উপনিষদে “অদ্বৈত বেদান্ত” বা একাত্মতার কথা বলা হয়েছে। “তত্ত্বমসি” (তুমি-ই তা) শ্লোকটি এর অন্যতম পরিচায়ক। এর মানে হলো, আমাদের সবার মধ্যে একটাই চেতনা আছে, যাকে ব্রহ্ম বলা হয়। আপনি, আমি, প্রকৃতি—সবকিছু সেই ব্রহ্মের অংশ। যদি আমরা এই সত্য উপলব্ধি করি, তাহলে কেউ কারো প্রতি হিংসা, ঘৃণা বা শত্রুতা পোষণ করবে না। কারণ সবাই একে অপরেরই অংশ। এটি কেবল ব্যাক্তিগত শান্তিই নয়, বিশ্বশান্তির এক মহান সূত্র।

ধর্ম ও কর্মের ভারসাম্য

উপনিষদে “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” বলে কর্ম করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে সেই কর্মের ফলের জন্য কখনোই আসক্তি থাকা উচিত নয়। আপনি যদি নিজে সৎভাবে কর্ম করেন, আপনার আশেপাশের মানুষও সেই শিক্ষা নেবে। এবং এই প্রভাবটা ধীরে ধীরে বড় আকারে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
যেমন, মহাভারতের যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যখন কর্মের শিক্ষা দেন, তখন তিনি শুধুমাত্র অর্জুনের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য কথা বলেছিলেন। উপনিষদে সেই একই বাণী পাওয়া যায়—নিজের ধর্ম পালন করুন, কিন্তু সেটা যেন অন্যের ক্ষতি না করে।

জীব এবং প্রকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য

উপনিষদে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথাও বলা হয়েছে। “ঈশাবাস্যমিদং সর্বং” শ্লোক অনুযায়ী, সারা জগৎ ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত। এই শিক্ষায় আমাদের শেখানো হয়, প্রকৃতি এবং প্রাণীর সুরক্ষার জন্য আমাদের দায়িত্ববোধ থাকা উচিত। আপনি কি জানেন, এই দায়িত্ব পালন করাটাও বিশ্বশান্তি আনার এক উপায়? কারণ প্রকৃতি সুরক্ষিত থাকলে, আমাদের জীবনও সুরক্ষিত থাকবে।

একটি গল্প: জনকের রাজসভায় যাজ্ঞবল্ক্য

উপনিষদে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যের একটি গল্প রয়েছে। একবার রাজা জনকের রাজসভায় এক প্রশ্ন ওঠে—“বিশ্বে শান্তি কীভাবে আনা সম্ভব?” তখন যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, “যখন মানুষ তার আসল স্বরূপ চিনতে পারবে এবং অন্যের কল্যাণে কাজ করবে, তখনই প্রকৃত শান্তি আসবে।” এই কথা আজও প্রাসঙ্গিক। আপনি যখন নিজে ভালো থাকবেন এবং অন্যের ভালো চান, তখন শান্তি আসবেই।

বিশ্বশান্তি: একটি সাধনা

উপনিষদ আমাদের শেখায় যে শান্তি কোনো বহিরাগত বিষয় নয়। এটা আমাদের অন্তরে বিদ্যমান। আপনার মনে যদি শান্তি থাকে, তাহলে সেই শান্তির প্রভাব চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। উপনিষদে বলা হয়েছে, “শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈত ম্।”— শান্তি, কল্যাণ, এবং একাত্মতা, এই তিনটি গুণের সমন্বয়ই হলো বিশ্বশান্তির মূল চাবিকাঠি।

আপনার জীবনেও যদি এই শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করেন, তাহলে নিজের মঙ্গল তো বটেই, সমাজ ও বিশ্বের মঙ্গলেও অংশীদার হতে পারবেন। আসুন, আমরা সবাই একসঙ্গে উপনিষদের এই মহান শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে আত্মস্থ করি।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top