উপনিষদের আলোকে পারিবারিক দ্বন্দ্ব সমাধানের উপায় কী?

যখন আমরা পারিবারিক দ্বন্দ্বের কথা ভাবি, তখন মনে হয় যেন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিবারই আমাদের প্রথম সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আর এর মধ্যে সৃষ্ট সমস্যাগুলো প্রায়ই আমাদের মানসিক শান্তি নষ্ট করে দেয়। কিন্তু উপনিষদ, যা জ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার, এই সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে দেওয়ার জন্য আমাদের দিশা দেখাতে পারে।

উপনিষদের মূল শিক্ষা

উপনিষদে বলা হয়েছে, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” – এই জগতে যা কিছু আছে, তা-ই ব্রহ্ম। তাই আমরা যখন পারিবারিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হই, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি সম্পর্ক ব্রহ্মেরই এক প্রকাশ। যদি আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি, তাহলে আমরা নিজের ইগোকে (অহং) দূরে রেখে সমস্যার মূল শিকড় খুঁজে পেতে পারি।

পারিবারিক দ্বন্দ্বের সাধারণ কারণ

যখন পরিবারে মতপার্থক্য হয়, তখন প্রায়ই তার মূলে থাকে –

  • ব্যক্তিগত ইগো বা অহংকার।
  • যোগাযোগের অভাব।
  • আর্থিক সমস্যাজনিত মানসিক চাপ।
  • বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে মতপার্থক্য।
  • প্রত্যাশার অতিরিক্ত চাপ।

এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে উপনিষদের আলোকে এগুলোর সমাধান করা যায়?

ইগো ত্যাগ করা

উপনিষদ বলে, “অহং ব্রহ্মাস্মি” – আমি ব্রহ্ম। এই উপলব্ধি আমাদের শেখায় যে, অহংকার ছেড়ে দিলে আমরা প্রকৃত জ্ঞানে উপনীত হতে পারি। ধরুন, আপনি এবং আপনার পরিবারের সদস্যের মধ্যে একটি তীব্র বাক-বিতণ্ডা চলছে। যদি আপনি ভাবেন, “আমিই ঠিক”, তাহলে সেই দ্বন্দ্ব কখনোই মেটার নয়। তবে যদি আপনি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন, “আমার আচরণ কি সত্যিই সম্পর্কের উন্নতি করছে?”, তাহলে আপনি সমাধানের দিকে এগিয়ে যাবেন।

সমবেদনা ও সহমর্মিতা

উপনিষদে বলা হয়েছে, “মৈত্রীং ভজন্তু” – সকলের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করুন। যদি আমরা পরিবারের সদস্যদের প্রতি মৈত্রী ও সমবেদনা দেখাই, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান আপনা-আপনিই হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ আর্থিক চাপে ভুগছে, আপনি কি তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন? যদি না দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে এখনই তা করার সময়।

আত্মনিয়ন্ত্রণ

“শমঃ, দমঃ, তপঃ” – এই তিনটি গুণ উপনিষদে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘শম’ মানে মনকে শান্ত করা, ‘দম’ মানে ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ, আর ‘তপ’ মানে আত্মশুদ্ধি। পারিবারিক দ্বন্দ্বের সময় আমাদের ইন্দ্রিয় এবং মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।

ধরুন, পরিবারের কোনো সদস্য আপনার ওপর রাগ করে চিৎকার করছে। যদি আপনি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে ঝগড়া বাড়ার বদলে মিটে যাবে।

প্রজন্মের ব্যবধান মেটানো

আজকের যুগে অনেক সমস্যার মূল কারণ প্রজন্মের ব্যবধান। তরুণ প্রজন্ম ও বয়স্কদের মধ্যে মতপার্থক্য প্রায়ই পরিবারের পরিবেশকে বিষিয়ে তোলে। উপনিষদে বলা হয়েছে, “পিতৃ দেব ভঃ” এবং “মাতৃ দেব ভঃ” – পিতা-মাতাকে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করুন। একইভাবে, তরুণদের প্রতি বয়স্কদের সহমর্মী হতে হবে। যদি উভয় পক্ষই একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করে, তাহলে এই ব্যবধান মিটে যাবে।

 প্রত্যাশা ও গ্রহণ

উপনিষদ বলে, “ত্যাগেন ভুঞ্জীথাঃ” – ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করো। আমাদের অনেক পারিবারিক সমস্যা জন্ম নেয় অতিরিক্ত প্রত্যাশা থেকে। যদি আমরা প্রত্যাশা কমিয়ে কৃতজ্ঞতায় জীবনযাপন করি, তাহলে পারিবারিক পরিবেশ আরও শান্তিপূর্ণ হবে।

সমস্যার সমাধানে যোগাযোগের গুরুত্ব

যোগাযোগের অভাব প্রায়ই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। উপনিষদের ভাষায়, “সত্যং ব্রূযাত্, প্রিয়ং ব্রূযাত্” – সত্য বলুন, কিন্তু তা যেন মধুর হয়। পারিবারিক দ্বন্দ্ব মেটাতে আপনাকে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসে তাদের অনুভূতিগুলো শোনার চেষ্টা করুন।

চূড়ান্ত পর্যালোচনা

উপনিষদ আমাদের শেখায় যে, প্রতিটি সমস্যার সমাধান আমাদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে। যদি আমরা নিজেদের অহংকার ত্যাগ করতে শিখি, পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা দেখাই এবং ধৈর্য ধরে প্রত্যেকের মতামত শুনি, তাহলে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব।

একটি ভাবনার সঙ্গে শেষ কথা

“তত্ত্বমসি” – তুমি-ই সেই। আপনি যদি নিজের ভেতরে সেই আত্মার আলোকে খুঁজে পান, তাহলে পারিবারিক শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত। এখন আপনার কাছে প্রশ্ন – আপনি কি আজ থেকেই উপনিষদের এই জ্ঞান আপনার জীবনে প্রয়োগ করতে প্রস্তুত?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top