আধুনিক জীবনের ছুটোছুটি, আরাম-আয়েশ আর আড়ম্বরের প্রতি আমাদের টান কি আমাদের সত্যিকার জীবনের উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? এই প্রশ্নটা আমি নিজেকে বহুবার করেছি। মনে পড়ে, যখন প্রথমবার উপনিষদের পাঠে বসি, এক অনন্য শান্তি অনুভব করেছিলাম। সেখানে আমি পেয়েছিলাম আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের বিপদ সম্পর্কে কিছু অনবদ্য সতর্কবাণী। আজ আমি সেই অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধিগুলো আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই।
আড়ম্বরের মূল সমস্যা
আড়ম্বরপূর্ণ জীবন মানে কি শুধু বিত্ত আর বাহ্যিক সুখ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে মনে পড়ে ঈশোপনিষদ-এর সেই বিখ্যাত উক্তি:
“তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা: মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ ধনম।”
উপনিষদ আমাদের শেখায় ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করতে। বাহ্যিক সম্পদের প্রতি অতিমাত্রায় আসক্তি আমাদের প্রকৃত আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আমি দেখেছি, যারা তাদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবন নিয়ে ব্যস্ত, তারা প্রায়ই অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগেন। আপনি নিজেও কি লক্ষ্য করেছেন, যে যত বেশি ভোগের পিছনে ছোটে, তার মনে তত বেশি অপূর্ণতা বোধ জমে? এই অনুভূতির কারণেই উপনিষদ বারবার আমাদের অন্তর্গত জীবনকে খুঁজে দেখতে বলে।
জীবনের উদাহরণ
একবার আমার এক বন্ধুকে দেখেছিলাম, যিনি তার জীবনে বিলাসী জীবনযাপনের জন্য পরিচিত ছিলেন। বড় বাড়ি, দামী গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ—সবকিছুই ছিল তার। কিন্তু তার মনের ভেতরটা ছিল শূন্য। একদিন, তিনি আমাকে বললেন, “এই সব কিছু থাকা সত্ত্বেও আমি সুখী নই। আমার মনে হয়, আমি সব হারিয়েছি।”
এমন অনেক উদাহরণই আমরা জীবনে দেখি। আসলে, বাহ্যিক সম্পদ যত বাড়ুক না কেন, যদি মনের ভিতর শান্তি না থাকে, তবে জীবন সত্যিকার অর্থে পূর্ণ হয় না। কাঠোপনিষদ-এর এই কথাটি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক:
“পরাঞ্চি খানি ব্যতৃণৎ স্বয়ম্ভূঃ, তস্মাত্ পরাং পশ্যতি নান্তরাত্মান।”
সৃষ্টি কর্তা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে বাহিরমুখী করেছেন, যার ফলে আমরা বাইরের জগতে মগ্ন হয়ে যাই এবং অন্তরের আত্মাকে দেখতে ভুলে যাই।
আড়ম্বরের চক্রে বন্দী হওয়া
আড়ম্বর আমাদের কেবল বাহিরমুখী করে তোলে না, এটি আমাদের চাহিদাকে কখনোই শেষ হতে দেয় না। ধরুন, আপনি একটি নতুন ফোন কিনলেন। কিছুদিনের মধ্যেই একটি নতুন মডেল বাজারে আসল, এবং পুরোনো ফোনটি আর আকর্ষণীয় মনে হলো না। এভাবে একটি লোভ আরেকটি লোভকে উস্কে দেয়। মুন্ডক উপনিষদ এই প্রসঙ্গে বলে:
“নয়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যঃ, ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।”
জীবনের সত্যিকারের উদ্দেশ্য কোনো বাহ্যিক অর্জনের মধ্যে নেই। এটি অর্জন করতে হলে আপনাকে আত্মচিন্তায় মনোযোগী হতে হবে।
প্রকৃত সুখের সন্ধান
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, প্রকৃত সুখ কোথায়? এটি কি আমাদের বাড়ি, গাড়ি বা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সে সীমাবদ্ধ? না, প্রকৃত সুখ আসে আমাদের অন্তর থেকে। আমাদের এই অন্বেষণে চান্ডোগ্য উপনিষদ এর একটি উক্তি স্মরণযোগ্য:
“সত্যমেব জয়তে নানৃতম।”
সত্যের পথে চললে, এবং নিজের মনের সত্যিকারের ইচ্ছা বুঝতে পারলেই আমরা সুখ খুঁজে পাব। আমি নিজে একবার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এই উক্তিটির সাহায্য নিয়েছিলাম। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বাহ্যিক আড়ম্বরের চেয়ে মনের শান্তি অনেক বেশি মূল্যবান।
আত্মিক উন্নতির পথ
যদি আপনি উপনিষদের এই শিক্ষাগুলি মেনে চলেন, তবে ধীরে ধীরে আপনার জীবনের আড়ম্বর আর চাহিদাগুলোর ভার কমতে শুরু করবে। নিজেকে প্রশ্ন করুন—এই সমস্ত বাহ্যিক চাহিদাগুলো কি আসলেই আপনার প্রয়োজন? আপনি কি সুখী? যদি উত্তর না হয়, তবে জানবেন, আপনার জীবনে অন্তর্দৃষ্টি আর আত্মচিন্তা প্রয়োজন।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ এর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে:
“আত্মানং বিদ্ধি।”
নিজেকে জানার মাধ্যমেই আপনি সবকিছু জানতে পারবেন।
ভাবনার শেষ কথা
আমাদের জীবনে আড়ম্বর থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেটি কখনোই জীবনের মূল উদ্দেশ্য হতে পারে না। আমরা যদি উপনিষদের পথনির্দেশ মেনে চলি, তবে আমাদের জীবন হবে অন্তর্ভেদী আর শান্তিময়।
আজকের লেখাটি শেষ করছি একটি প্রশ্ন দিয়ে, যা আপনাদের নিজের ভেতর গভীরভাবে ভাবতে সাহায্য করবে:
“আপনার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? আপনি কি বাহ্যিক সুখের পিছনে ছুটছেন, নাকি অন্তরের শান্তির সন্ধানে?”
আসুন, উপনিষদের শিক্ষা অনুসরণ করে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য খুঁজে নিই।