“অহিংসা পরম ধর্মঃ”—এই অমৃত বাণী আমাদের সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি। অহিংসা কেবলমাত্র একটি গুণ নয়, এটি জীবনযাত্রার এমন একটি পন্থা যা আমাদের সৎ, উদার এবং কল্যাণময় জীবনযাপনের দিকে নিয়ে যায়। উপনিষদে বলা হয়েছে যে অহিংসা এমন একটি শক্তি যা জীবনের গভীরতম সত্যের সাথে আমাদের যুক্ত করে। আসুন, বুঝি কীভাবে এই অহিংসা আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র হতে পারে।
অহিংসার অর্থ
অহিংসার মানে কি শুধুই শারীরিকভাবে কারও ক্ষতি না করা? না, উপনিষদের দৃষ্টিতে অহিংসা হলো মন, বাক্য এবং কর্মে কোনো প্রাণীর প্রতি বিরূপ আচরণ না করা।
ঋগ্বেদ এবং যজুর্বেদে অহিংসার গুরুত্ব বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে কেবলমাত্র দেহগত সহিংসতা নয়, আমাদের ভাবনা, বাক্য, এবং কর্মেও অহিংসা থাকা উচিত। অর্থাৎ কারও প্রতি ঈর্ষা, ক্রোধ, কিংবা বিদ্বেষ পোষণ করাও এক প্রকার হিংসা।
অহিংসা: একটি উপনিষদীয় দৃষ্টান্ত
মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে যে, “সত্যমেব জয়তে নানৃতম্”। সত্য এবং অহিংসা পরস্পরের পরিপূরক। যখন আমরা সত্য এবং অহিংসার পথে চলি, তখনই আমরা প্রকৃত ধ্যান এবং জ্ঞান লাভ করতে পারি। একবার একজন ঋষি তার শিষ্যকে অহিংসার গুরুত্ব বোঝাতে বলেছিলেন, “জীবন এমনভাবে জিও যাতে কারও হৃদয়ে আঘাত না লাগে। একমাত্র তখনই তুমি ব্রহ্মের আস্বাদ নিতে পারবে।”
অহিংসা এবং ভগবান মহাবীরের জীবন
ভগবান মহাবীর আমাদের অহিংসার পথ দেখিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিটি জীব ব্রহ্মের অংশ এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোই প্রকৃত ধর্ম। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখি যে, সহানুভূতির শক্তি হিংসার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
অহিংসার মাধ্যমে জীবনের উন্নতি
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন অহিংসা জীবনের মূলমন্ত্র হতে পারে? কারণ এটি আমাদের হৃদয়কে শান্ত এবং অন্তর্দৃষ্টিকে পরিশুদ্ধ করে। অহিংসা আমাদের শিক্ষা দেয় কেবলমাত্র নিজের স্বার্থে নয়, বরং সর্বজনের মঙ্গল কামনা করতে।
অহিংসা পালন করলে:
- মন শান্ত থাকে: ক্রোধ এবং বিদ্বেষের অভাবে মন শান্ত থাকে।
- সম্পর্ক মজবুত হয়: সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
- প্রকৃত সাফল্য আসে: অহিংসা পথের যাত্রী সব সময় আত্মিক এবং সামাজিক সাফল্য লাভ করেন।
অহিংসার উদাহরণ: শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা
গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, “সমদর্শিতা এবং সমবেদনা আমাদের প্রকৃত ধর্ম।” এখানে অহিংসা মানে কেবলমাত্র যুদ্ধ না করা নয়, বরং মনকে নির্মল এবং স্থির রাখা।
আমাদের জীবনে অহিংসার প্রাসঙ্গিকতা
আজকের দ্রুতগতির জীবনে অহিংসার চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চারপাশে যখন ক্রোধ, লোভ, এবং বিদ্বেষের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তখন অহিংসাই হলো সেই শক্তি যা আমাদের আত্মিক মুক্তি দিতে পারে। অহিংসার পথে চললে আমাদের পরিবার, সমাজ এবং পরিবেশে এক নতুন ধরনের সমন্বয় আসবে।
সনাতন ভাবনায় শান্তির পথ
অহিংসা শুধু সনাতন ধর্মের নয়, এটি প্রতিটি ধর্মের একটি সার্বজনীন সত্য। সনাতন ধর্মে অহিংসার বার্তাটি শুধুই আদর্শ নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি বাস্তব শিক্ষা। তাই আসুন, অহিংসার পথকে গ্রহণ করে নিজের এবং পরিপার্শ্বের শান্তি নিশ্চিত করি।
“অহিংসা হি ধর্মমুদাহরন্তি।”
এই পথেই আমরা সত্যিকারের ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করব।